বৈষম্য ও দারিদ্য পরিস্থিতির উন্নতিতে যখন ভাটা

162
রায়হান আহমেদ তপাদার:

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে চলেছি। আমাদের মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি, কৃষি সম্প্রসারণ, শিল্পের উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস,বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী নাগরিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি ও পোশাক শিল্পের ব্যাপক অগ্রগতিসহ রফতানি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলেছে। তবে এ অগ্রগতি প্রশংসনীয় হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী এগোতে পেরেছে এমন নয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে আমাদের বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তা উত্তরণের জন্য আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার, বিরাট জনসংখ্যাকে উৎপাদনশীল কাজে নিয়োগের ব্যবস্থা করা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের প্রতি সরকারকে নজর দিতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী এক দশক আমাদের অর্থনীতি মূলত ছিল কৃষিনির্ভর।যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে অর্থনীতির কাঠামো ছিল নাজুক অবস্থায়। ১৯৭২-৭৩ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৭৫ ভাগ। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩.০৮ শতাংশ। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন পটপরিবর্তন যেমন: গণতান্ত্রিক শাসক, সামরিক শাসক, স্বৈরশাসক অর্থাৎ রাজনৈতিক বিভিন্ন সরকারের আমলে অর্থনীতির গতি উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থায় পৌঁছে। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি কৃষির পাশাপাশি শিল্প ও সেবাখাত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষি এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে অগ্রগতি লাভ করছে। ৫১ বছরে অর্থনীতি অনেক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করলেও এতে তুষ্টির অবকাশ নেই। এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। আমাদের দীর্ঘ পথ চলা আশানুরূপ না হলেও সন্তোষজনক ছিল। তবে সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। এগুলো আলোচনা-পর্যালোচনার প্রয়োজন। 

ঠিক কোন কারণে আমরা সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করতে পারিনি, দেশকে দ্রুত এগিয়ে নেয়ার সম্ভাবনাও কাজে লাগাতে পারিনি, সেসব বিষয় পর্যালোচনায় আসতে হবে। বর্তমানে ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ খাতের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, ঋণ আদায়ের হার হ্রাস ও বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। দ্রুত সঙ্কট উত্তরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত হাতে, ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে সময়োচিত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে মানবাধিকারের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও এ সমস্যার সমাধান না করতে পারলে আগামী দিনে অর্থনীতি কোন দিকে যাবে তা ভেবে দেখতে হবে।
বর্তমানে নতুন বিনিয়োগ না হওয়া, কর্ম সংস্থানের অভাব, শিক্ষার নাজুক অবস্থা, কোনো প্রকল্প যথাসময়ে শেষ না হওয়া ইত্যাদি, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির শর্ত বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে থাকবে। স্বাধীনতার ৫১ বছরে নিজেদের অর্জন ও ব্যর্থতাগুলোর বিশ্লেষণ ও দুর্বলতা গুলো চিহ্নিত করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। জবাব দিহিতা ও স্বাধীন মতপ্রকাশ সঙ্কুুচিত হচ্ছে। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে। এ সময় দুর্যোগকালীন সঙ্কট মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতির বিষয়গুলো নিয়েও ভাবতে হবে। সম্প্রতি বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ (এফএও) পাঁচটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। পুষ্টিকর বা স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সংগতি নেই জনসংখ্যার ৭৩ শতাংশেরই। প্রতিবেদন প্রণয়নকারী অপর চারটি সংস্থা হলো আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্যের জোগানে এগিয়ে আছে ভুটান ও শ্রীলঙ্কা। এরপর যথাক্রমে ভারত ও বাংলাদেশের অবস্থান। 

সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে নেপাল। পাকিস্তান বাংলাদেশের পেছনে। স্বাধীনতার পর গত ৫১ বছরে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। কেবল ধান নয়, মাছ, সবজি, ফল, দুধ, ডিম, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি উৎপাদনেও আমাদের অগ্রগতি যথেষ্ট। তারপরও অধিকাংশ মানুষের নাগালে স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর খাবার না থাকার কারণ আয়বৈষম্য। দ্রুত ধনী হওয়া তালিকার শীর্ষে থাকা বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমছে খুবই মন্থরগতিতে। অন্যদিকে ধনী ও গরিবের বৈষম্য বাড়ছেই। উল্লিখিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে একজন মানুষের দৈনিক স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর খাবারের জন্য খরচ পড়ে প্রায় ২৭৬ টাকা। অথচ চার ভাগের তিন ভাগ মানুষেরই এ খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। ২০১৪-১৬ সময়কালে তীব্র থেকে মাঝারি ধরনের খাদ্য অনিশ্চয়তায় ছিল ৫ কোটি ৪ লাখ মানুষ। তিন বছর পর ২০১৯-২১ সময়কালে একই ধরনের খাদ্য অনিশ্চয়তায় ছিল ৫ কোটি ২৩ লাখ মানুষ। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ এ অনিশ্চয়তায় ছিল। এ হিসাবে ৬৮ শতাংশ মানুষের খাদ্য বিষয়ে অনিশ্চয়তা নেই। তবে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ স্বাস্থ্যকর খাবার খায় না বা খেতে পারে না। গড়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের দিনে ২১০০ কিলোক্যালরির প্রয়োজন। সমাজে বিদ্যমান এই উৎকট বৈষম্যের চিহ্নগুলো বাহ্যিকভাবে হয়তো চট করে চোখে পড়ে না, কিন্তু একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে কিংবা অভিনিবেশ সহকারে ভাবলেই এর অস্তিত্বটুকু স্পষ্ট টের পাওয়া যাওয়ার কথা। অবশ্য মাঝে মধ্যে দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতেও এ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হতে দেখি আমরা। যেমন, গেল মাসেই একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকে এই করোনাকালের মধ্যেও বিশ্বে কোটিপতিদের সংখ্যাবৃদ্ধির চাঞ্চল্যকর একটি খবর দেখেছি, যার উৎস সুইজারল্যান্ডভিত্তিক একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্ট ২০২১। এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও, গেল দুই বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে আট হাজার, যাদের একেকজনের মোট সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে দশ থেকে পঞ্চাশ কোটি টাকা। 

পাশাপাশি, এই করোনাকালের মধ্যেই দেড়, দুই কোটি মানুষের নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার খবরও আমরা পড়েছি কোনো কোনো কাগজে ও অনলাইন পোর্টালে। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের দুই প্রান্তের এই দুই বিপরীতমুখী প্রবণতা আর কিছু নয়, আমাদের সমাজ-অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান বৈষম্যেরই জোরাল একটি সূচক। অর্থনীতির মূল বিষয় দারিদ্র্য অধ্যয়ন। তাই তিনি উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য ও দারিদ্র্য দূরীকরণের বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা করেন। ১৯৯০ সালে তিনি দৈনিক এক মার্কিন ডলার দারিদ্র্যরেখা প্রস্তাব করেন। তিনি এবং বিশ্বব্যাংকে তাঁর সহকর্মীরা এ ভিত্তিতে দরিদ্রের সংখ্যা ও অর্জিত অগ্রগতি পরিমাপ করেন। ২০০৮ সালে অন্যদের সঙ্গে প্রধান সহলেখক হিসেবে এক প্রতিবেদনে তিনি দেখান যে চরম দারিদ্র্যে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১৯৮১ সালে ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন থেকে ২০০৫ সালে ১ দশমিক ৪ বিলিয়নে নেমে এসেছে, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণ বলে তিনি জানান। তবে একই সঙ্গে তিনি বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য কেবল প্রবৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হলে মানব উন্নয়নে বৈষম্য (প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা) দূর ও বিনিয়োগের জন্য দরিদ্রদের ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ অবারিত করতে হবে। তাই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বিজয় দাবি না করে তিনি সতর্ক করেছেন, বর্তমান আয়বৈষম্য অব্যাহত থাকলে, আগামী ১৫ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও, বিশ্বের এক বিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারবে না। ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কালচারাল চেঞ্জ পত্রিকায় ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হোয়েন মেথড ম্যাটারস: মনিটরিং পোভার্টি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিমাপের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ও এর সংশোধনের পথনির্দেশ করেন। তাঁরা দেখান যে আশির দশকে দারিদ্র্য পরিস্থিতির কথিত উন্নতি কেবল ভ্রান্ত পরিমাপপদ্ধতি ও জরিপ নকশার ফলশ্রুতি। ভ্রান্ত পরিমাপ পদ্ধতি সংশোধন করে তাঁরা দেখান যে আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত দারিদ্র্যের আপতন, গভীরতা ও নির্মমতা কমলেও তা পরবর্তী সময়ে টেকসই হয়নি। 

তাঁরা আরও দেখতে পান যে বিভিন্ন সমীক্ষায় শহুরে দারিদ্র্যের আপতন গ্রামীণ দারিদ্র্যের তুলনায় বেড়েছে-এমন দাবি ধোপে টেকে না। তাঁদের সব পরিমাপেই গ্রামীণ দারিদ্র্য শহুরে দারিদ্র্যের তুলনায় বেশি এবং তা অপরিবর্তিত আছে। আশির দশকে দারিদ্র্য পরিস্থিতির যে সামান্য উন্নতি হয়েছে, তার ফলে শহুরে দরিদ্ররাই কেবল উপকৃত হয়েছে। বর্তমানে রাজনৈতিক চাপে তা আরও দুর্বল হয়েছে। দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হলে প্রথমেই পরিসংখ্যানব্যবস্থার ত্রুটি নিরাময় এবং এ বিভাগকে অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে। কোভিড-১৯ এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস, এমনকি ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ও সৃষ্ট বেকারত্বের কারণে বিশ্বব্যাপী এবং বাংলাদেশে দারিদ্র্য বেড়েছে।বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, কেবল ২০২০ সালেই কোভিড-১৯ মহামারির ফলে বিশ্বব্যাপী ৯ কোটি ৭০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে চরম দারিদ্র্য পরিস্থিতির অগ্রগতি তিন থেকে চার বছর পিছিয়ে গেছে। বাংলাদেশেও মহামারির ফলে দারিদ্র্য বেড়েছে। করোনা পরিস্থিতির আগে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) জরিপ করে দেখেছে, করোনাকালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অতি দারিদ্র্য। তিন গুণ বেড়ে এটি এখন হয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। কোভিড-১৯ মহামারি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে অভিযানে ভাটা এনেছে। নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে শতসহস্র মানুষ। দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণার জন্য অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্তার দুফলো ও মাইকেল ক্রেমার নোবেল পুরস্কার পেলেও অর্থনীতির অন্যান্য শাখার তুলনায় আয়বৈষম্য ও দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা অনেক পিছিয়ে আছে। কারণ, লগ্নি করা পুঁজির কর্ণধারেরা কেবল প্রবৃদ্ধির জয়গান করা গবেষণাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে থাকেন। 

অথচ দারিদ্র্য নিয়ে যেমন দুর্নীতি ও দারিদ্র্য, স্বৈরাচার ও দারিদ্র্য-এমন সব বিষয় নিয়ে আরও ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও নকশা সঠিক ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া দারিদ্র্য নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে বিশ্বব্যাপী ও বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে। আমরা কোন দেশ থেকে এগিয়ে থাকলাম, আর কোন দেশ থেকে পিছিয়ে থাকলাম, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলাদেশের শত ভাগ মানুষ পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে কি না। এর সরল উত্তর হলো, না। কোনো দেশের খাদ্য স্বনির্ভরতা প্রমাণ করে না যে সেই দেশের সব মানুষ স্বাস্থ্যকর খাদ্য পাচ্ছে। সুষম খাদ্য দূরে থাক, বাংলাদেশ এখনো প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্যনিরাপত্তাই নিশ্চিত করতে পারেনি। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে; যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। আবার খাদ্যসহায়তা মানে কেবল চাল নয়, পুষ্টিকর অন্যান্য খাবারও দেওয়া জরুরি। শিশুদের পুষ্টি সমস্যা সমাধানে বিদ্যালয় পর্যায়ে দুপুরের খাবার দেওয়া হচ্ছে। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। একই সঙ্গে নারীদের জন্যও আলাদা খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতিবিষয়ক অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে নারীদের ৩৭ শতাংশ পুষ্টি সমস্যায় ভুগছিল। গত দুই বছরে পরিস্থিতির ইতরবিশেষ ঘটেছে বলে মনে হয় না। তবে খাদ্যসহায়তাও স্থায়ী সমাধান নয়। প্রত্যেক নাগরিক যাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে, সে জন্য তার সামর্থ্য তৈরি করতে হবে। এখনো দেশের শ্রমজীবী মানুষের বৃহত্তর অংশ যে আয় করে, তা দিনে পুষ্টিকর খাবারের জন্য যে ২৮৬ টাকা প্রয়োজন, তার চেয়ে কম। আমরা যদি সত্যিই একটি স্বাস্থ্যবান জাতি গড়ে তুলতে চাই, নাগরিকের আয় যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি কমাতে হবে সামাজিক বৈষম্যও।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট