শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে আরো মনোযোগ জরুরি

119
রায়হান আহমেদ তপাদার:

শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের যেমন কিছু সাফল্য আছে, তেমনি ব্যর্থতাও অনেক। প্রাথমিক পর্যায়ে শতভাগ শিশু বিদ্যালয়ে এলেও ২০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারে না। এরপর যারা মাধ্যমিক পর্যায়ে যায়, তাদেরও ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষা সমাপনের আগেই ঝরে যায়। অর্থাৎ এসএসসি পাস করার আগেই ঝরে যায় অর্ধেকেরও বেশি। সরকারি হিসাবেই এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এটি দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতাই তুলে ধরে। ঝরে পড়ার সঠিক কারণগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা একটি জাতির উন্নতির সোপান হিসেবে গণ্য হয়। এজন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে প্রাক-প্রাথমিকের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে পদার্পণ শুরু হয়। সব মিলিয়ে শিশুর সাক্ষরতার প্রথম ধাপ হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সরকার উন্নত জাতি গঠনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তিও দিচ্ছে। এসব সুবিধা দেয়ার পরও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। দেশের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া শুধু নির্দিষ্ট কোনো পর্যায়ে নয়। বরং প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করতেই ঝরে পড়ার সংখ্যা শুরু হয়। সবচেয়ে বেশি ঝরে পড়ে মূলত অষ্টম শ্রেণি থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে। এরপর উচ্চমাধ্যমিকে যারা পাস করতে ব্যর্থ হন ঝরে পড়ার তালিকায় রয়েছে তাদের নামও। আবার অনেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগের অভাবে ঝরে পড়ছে। তবে প্রশ্ন হলো, কেন এতসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে? এ ক্ষেত্রে প্রধানতম কারণ দরিদ্রতা। বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে সাধারণত শিক্ষার্থী বেশি ঝরে পড়ে। অথচ এর পরিণতি যে কত করুণ হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য সত্যিই অস্বস্তির। বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের বেশির ভাগ পরিবারই দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করে। সেখানে তাদের নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে থাকতে হয়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যা। বিভিন্ন পরিবারেই দেখা যায়, সন্তান একটু বড় হয়ে উঠলেই তাকে উপার্জনে পাঠাতে উদ্যত হন অভিভাবকরা। ফলে অনেকেই পড়া লেখা না করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে এক রকম বাধ্য হয়েই। এ কারণে প্রতিনিয়ত দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। বিপরীতে কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। অথচ শিশুশ্রম প্রতিরোধে দেশে আইন রয়েছে। কিন্তু আইন থাকলেও তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়ায় আইনের তোয়াক্কা না করে বেড়েই চলছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। আবার যারা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হতে পারেননি তারা অনেক সময় পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে এদের বড় একটি অংশ চলে যায় কর্মসংস্থানে। অনেকে আবার যায় বিদেশে। এটা শুধু যে এ বছর হবে, তা কিন্তু নয়। এটা প্রায় প্রতি বছরই নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে শঙ্কার খবর হলো, এর সংখ্যাটা দিন দিন শুধুই বাড়ছে। অথচ আমরা কখনো ভেবে দেখি না, দেশের সার্বিক অগ্রগতির পথে এটা একটি বড় বাধা। কারণ এভাবে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার মানে হলো এতে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি আরো একটি তথ্য আমাদের বেশি শঙ্কা জাগাচ্ছে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ সমাজে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে অপরাধ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। দেখা যায়, যাদের স্কুলে থাকার কথা তারা যখন জীবিকার তাগিদে ঝরে পড়ছে, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এর সঙ্গে জড়িত অনেক কিছু। অনেক সময় দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষাচক্র করতে পারে না। এর মাঝে মধ্যবর্তী যেকোনো সময়ে যেকোনো শ্রেণি থেকে ঝরে পড়ে তারা। 

আমাদের দেশে মূলত বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এরমধ্যে প্রধান কারণ গুলো হলো অভিভাবকের অসচেতনতা, দারিদ্র্যতা, মেয়েশিশুর প্রতি অবহেলা, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, বিদ্যালয়ের সময়সূচি, বিদ্যালয়ের ভৌত সুবিধাদি ও সর্বোপুরি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে ঝরে পড়া রোধ করার জন্য সবার আগে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় জনসমাজের সম্পৃক্ততাও জরুরি। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করা, বিদ্যালয়ে খেলাধুলাসহ নিয়মিত সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা, বিদ্যালয়ের যাতায়াত ব্যবস্থা নিরাপদ রাখা, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হলে অনেকাংশে রোধ করা যাবে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আরো একটি বড় কারণ মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারা। তাই এ বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে। এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। বিশেষ করে বিনামূল্যে বই দেওয়া থেকে শুরু করে উপবৃত্তি, স্কুলে মিড ডে মিল। এর জন্য সরকারকে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের টাকাও খরচ করতে হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ ক্ষেত্রে যেসব জায়গায় সমস্যা রয়েছে, সেই বিষয়গুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য সরকারকে আরো বেশি উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে এত সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও শিক্ষার্থী কমে যাওয়া প্রত্যাশিত নয়। এজন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসের ভূমিকা প্রয়োজন। বিশেষ করে শিক্ষকরা যেন পাঠদানে মনোযোগী দেন, সেটি কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে। অভিভাবকরা যেখানে মানসম্মত শিক্ষা পাবেন, সেখানেই সন্তানকে ভর্তি করাতে চাইবেন। তাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। 

উন্নত দেশগুলোয় প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। এজন্য আমাদের দেশে সরকারের যে ভূমিকা রয়েছে, তার যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। কেননা যে পরিমাণ অর্থ প্রাথমিক শিক্ষা খাতে ব্যয় হচ্ছে, সেটির ফলাফল পেতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের নৈতিকতার বিষয়টিও জড়িত রয়েছে, সরকারের বেতনভোগী হয়ে ঠিকমতো পাঠদান না করলে নিজের বিবেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া দরকার। তাছাড়া সরকারি ব্যয় হিসেবে প্রশাসনেরও তদারকিতে ঘাটতি রাখা যাবে না। সব মিলিয়ে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় রাখতে সরকারি স্কুলগুলোর যে ভূমিকা রয়েছে, তা যেন গৌণ না হয়ে পড়ে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করব, শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক স্কুল পরিচালনায় যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। সেই সঙ্গে সরকারি স্কুলগুলোয় মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলা হবে,এটিও আমাদের কাম্য। সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নানা ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। হতে পারে সেটি সাংস্কৃতিক, খেলাধুলা অথবা কুইজ প্রতিযোগিতা। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সরকার কর্র্তৃক যেসব সুবিধা দেওয়া হয়, প্রয়োজনে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সবার বাড়িতে গিয়ে সেসব উপস্থাপন করে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। কেননা, দেশের শিক্ষাক্ষেত্রকে এগিয়ে নিতে প্রাথমিক শিক্ষার বিকল্প নেই। সরকার গুরুত্ব বিবেচনা করেই প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু এখন দেশের প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে সব জায়গায় শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অল্প বয়সে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা তাদের অর্জিত জ্ঞান কোনো কাজে লাগাতে পারে না। ফলে তারা সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে সমাজের বোঝায় পরিণত হয়। 

প্রথম শ্রেণিতে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তার মধ্যে মাত্র ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এসএসসি পাস করে। বাকিরা দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে লেখাপড়া থেকে ছিটকে পড়ে।বিষয়টি উদ্বেগজনক। সেই সঙ্গে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ঝরে পড়ে অর্ধেক শিক্ষার্থী। পঞ্চম শ্রেণি শেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সাত বছরের শ্রেণি কার্যক্রমে প্রায় ১৭ লাখের বেশি শিক্ষার্থী শিক্ষার স্বাভাবিক পথ থেকে ছিটকে পড়েছে। মেয়ে ও ছেলেশিশুদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে। দেশে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিকে ভর্তির হার বাড়ছে। এটি ইতিবাচক। জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এবার উচ্চ মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থী বেড়েছে। সব মিলিয়ে অর্ধ লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থী বেড়েছে। তারপরও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার অন্যান্য কারণও উদঘাটিত হওয়া দরকার। কারণ যা-ই হোক না কেন, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। সমাজের দরিদ্রতম ব্যক্তিটিও চান তার সন্তান লেখাপড়া করুক। কিন্তু লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করতে না পারার কারণেও অনেকের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না। দারিদ্র্য দূর করা না গেলে শিক্ষাক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করা কঠিন হবে। শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করা ও ধরে রাখার জন্য সরকার ইতিমধ্যে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে, বিনামূল্যে বইও দেওয়া হচ্ছে। তারপরও শিশুদের ধরে রাখা যাচ্ছে না। অভিজ্ঞ মহল মনে করছে, শিক্ষার্থীরা যাতে অল্প বয়সে ঝরে না পড়ে সে জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ অবস্থায় বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সমস্যার সমাধানে মনোযোগী হতে হবে। প্রাথমিক-মাধ্যমিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে হলে নাগরিকদের জীবন মান উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা খাতের অব্যবস্থাপনা, অদূরদর্শিতা, দুর্নীতি-এসবও দূর করতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করি, দেশে প্রত্যেক শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষা সম্পন্ন করে সম্পদে পরিণত হতে পারে সে জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 
raihan567@yahoo.com