শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিতে হোক মে দিবস

17
রায়হান আহমেদ তপাদার:
পৃথিবীর মেহনতি মানুষের জন্য আজকের দিনটি একটি মাইলফলক এবং ঐতিহাসিক সত্য। কারণ এই দিনটির মাধ্যমে তারা তাদের কাজের প্রকৃত স্বীকৃতি পেয়েছে, পেয়েছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। এই দিনটিকে পাওয়ার জন্য শ্রমিকরা তাদের নিজের জীবন রক্ষার জন্য, ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবাদ-সংগ্রাম করেছে মালিকদের বিরুদ্ধে। অবশেষে তারা শ্রম-অধিকার ও মর্যাদা আদায় করে নিয়েছে। যুগে যুগে দেশে দেশে সমাজে খেটে-খাওয়া শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি মানুষ দেশ-জাতির উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। তাদের অবদানকে সব সময় ছোট করে দেখা হয়েছে। অথচ যে কোনো দেশের উৎপাদন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে তারাই বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। আবার তারাই সবচেয়ে বেশি শোষিত ও বঞ্চিত হয়েছে। নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাজনক। মানবসভ্যতা প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে যায় শ্রমিকের রক্ত পানি করা ঘামে। তাই এই সভ্যতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছে শ্রমিক শ্রেণি। শিল্প বিপ্লবের পর বিশ্বের নানান প্রান্তে শ্রমঘন এলাকা তৈরি হয়েছে, যেখানে বিপুল পরিমাণ শ্রমিক একটি কারখানা বা শিল্পকে কেন্দ্র করে একত্র হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণির নিজেদের অধিকার আদায়ের প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ হয়েছে, শ্রমিক ইউনিয়ন হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীজুড়ে শ্রমিকের কর্মঘণ্টার ব্যাপারটি সুরাহা হয়নি, বৃহৎ পুঁজির অধিকারি মালিকপক্ষ ঠিক করে দিচ্ছে শ্রমিকের কয় ঘণ্টা কাজ করতে হবে। দৈনিক ১০ থেকে ১২ কিংবা তার চেয়ে বেশি ঘণ্টা কাজ আদায় করিয়ে নেওয়া হয়েছে একজন শ্রমিকের কাছ থেকে। এই দীর্ঘ কর্মঘণ্টার প্রভাব পড়েছে তার দৈনন্দিন জীবনে। তাই বিশ্বের নানা প্রান্তের শ্রমিক সংগঠনগুলো আট ঘণ্টা কাজকে ‘প্রমাণ কর্মঘণ্টা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে।
মে মাসের ১ তারিখ যে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হয়ে থাকে,সেটিও মূলত আট ঘণ্টা কাজের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন হিসেবেই শুরু হয়েছিল। তবে এই আন্দোলন বিশ্বজুড়ে শ্রমিক শ্রেণির সামগ্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে এ আন্দোলনের প্রভাব ছিল ব্যাপক, বিশেষ করে ইউরোপের শ্রমঘন এলাকায় এ ঘটনা ব্যাপক প্রভাব ফেলে। শিকাগোতে শিল্পায়নের বিকাশের সময় প্রচুর জার্মান, ব্যাভারিয়ান শ্রমিক সেখানে স্থায়ী হয় এবং এ শ্রমিক আন্দোলনেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের যুক্ত থাকার সুবাদে এ ঘটনা ইউরোপে বেশ প্রভাব ফেলে। ১৯১৭ সালের পর বিশেষ করে বিশ্বজুড়ে সোভিয়েত রাশিয়ার বৈপ্লবিক উত্থানের পর সোভিয়েত ক্ষমতাবলয়ে থাকা দেশগুলোতে মে মাসের ১ তারিখে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বেশ ঘটা করে পালন শুরু হয়। সোভিয়েত পতনের পরে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক দেশেই পালন হয় না মে দিবস, তবে এখনও বিশ্বের অনেক দেশেই এ দিন সরকারি ছুটি হিসেবে চিহ্নিত। বিশ্বজুড়ে এখনও শ্রমিক অসন্তোষ বন্ধ নেই, ২০১৯ সালে ফ্রান্সে দেখা গেছে ‘ইয়োলো ভেস্ট’ আন্দোলন। শুধু এটিই নয়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নিয়মিতই শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। এটিও প্রমাণ করে পুঁজি টিকিয়ে রাখা এবং মুনাফার স্বার্থে কর্মজীবীদের ক্রম শোষণ করেই যাচ্ছে বৃহদাকার প্রতিষ্ঠানগুলো, একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে বাকিদের বেতনের বৈষম্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে নতুন করে। তাই মে দিবস নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস এখনও বিশ্বের নিপীড়িত কর্মজীবী মানুষকে পথ দেখায়, তাদের অধিকার আদায় করে নিতে। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে পহেলা মে তারিখকে ঘোষণা করা হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। 
এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে মে দিবস। ঐতিহাসিক ও মহান মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এবং বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের দিন। মনে রাখতে হবে, দেশ ও জাতির উন্নয়নে শ্রমিকদের মর্যাদা প্রদান অতি আবশ্যক। এক অর্থে সব শ্রমজীবী মানুষকে শ্রমিক বলা যেতে পারে।শুধু পরিবহন, পোশাক কিংবা কলকারখানায় কাজ করা, নিচের পদের মানুষকে শ্রমিক হিসেবে গণ্য না করে কায়িক পরিশ্রম করা মানুষকেই শ্রমিক হিসেবে দেখা যেতে পারে। হোন তিনি দিনমজুর কিংবা চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী। সবাই শ্রম দিচ্ছেন যার যার স্তরের শ্রমিক হিসেবে। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্মারক হিসেবে পহেলা মে সারা বিশ্বে মে দিবস পালিত হয়। এ দিবসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে। ঊনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত শ্রমিকদের ছিল না কোনো ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা, ছিল না কাজের নির্দিষ্ট সময়ের সীমা। মালিকরা তাদের খেয়ালখুশি মতো শ্রমিকদের দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটাতেন। ১৮৭৭ সালে ন্যায্য মজুরি, আট ঘণ্টা কর্মদিবস ও অন্যান্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিকরা ব্যাপক ধর্মঘট পালন করেছিল। এই ন্যায্য আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হয়। গুলিতে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত ৩০০ শ্রমিক আহত হয়েছেন। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অনেক শ্রমজীবী মানুষ নিপীড়নের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন প্রচণ্ড দুর্বার আন্দোলন। সেই দিন যুক্তরাষ্ট্রের ১১ হাজার ৫৬২টি শিল্পকারখানাসহ সব শিল্পাঞ্চলে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন শ্রমিকরা। শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেট রূপ নেয় লাখো শ্রমিকের বিক্ষোভের সমুদ্রে। শহরের তিন লক্ষাধিক মেহনতি মানুষ কাজ বন্ধ রেখে সংগ্রামের জন্য রাস্তায় নেমে আসেন।
এ সময় আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ওপর বিনা উসকানিতে নির্বিচারে গুলি চালায় সরকারের পুলিশ। গুলিতে ওই দিনই নিহত হন ১০ জন শ্রমিক, আহত হন হাজার হাজার শ্রমিক। তবুও অব্যাহত থাকে ধর্মঘট ও আন্দোলন। এরপর ৩ মে রিপার কারখানার সামনে প্রতিবাদ সভায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান আরও ছয়জন শ্রমিক। এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৪ মে শিকাগোর ‘হে’ মার্কেট স্কয়ারে স্মরণাতীতকালের বিশাল শ্রমিক-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে আবারও বর্বরোচিত হামলা চালায় পুলিশ বাহিনী। ওই ঘটনায় চারজন শ্রমিক ও সাত পুলিশ নিহত হয়। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কথিত অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয় বহু শ্রমিককে। গ্রেপ্তারকৃত ছয়জন শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগারে আত্মহনন করেন এক শ্রমিক। কারাগারে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন করা হয় হাজার হাজার শ্রমিককে। দাবি আদায়ের জন্য সেদিন শ্রমিকদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। হে মার্কেটের শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও রক্তস্নাত প্রতিরোধযুদ্ধে এবং আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিজয় হয়। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে অধিকার আদায়ের সংগ্রামের এদিনে শ্রমিকরা বুকের রক্ত ঝরিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন এক অপার উপাখ্যান। অবশেষে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় সরকার। জীবন দানের বিনিময় শ্রমিকদের সেই দাবি আজ বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। আমাদের দেশেও এ দিনটি পালন করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে জাতির পিতার উদ্যোগ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। 
একইসঙ্গে আইএলও’র ৬টি কোর কনভেনশনসহ ২৯টি কনভেনশন অনুসমর্থন করে। এটি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের অধিকার রক্ষায় এক অনন্য মাইলফলক। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, একদিকে শোষক আর অন্যদিকে শোষিত; আমি শোষিতের পক্ষে। তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সে স্বপ্নপূরণে শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে সবাইকে দলমত নির্বিশেষে একাত্ম হতে হবে। এই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে শ্রমিক-মালিক সম্প্রীতি দেশের উন্নয়নের পথকে ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের শ্রমিকরা আজ অবহেলিত। তাদের নেই কোনো অধিকার। নেই কোনো যথার্থ মূল্যায়ন। শ্রমিকরা আদৌ ন্যায্য অধিকার পাচ্ছে না?। বৈষম্যের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর তারা যদি ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করে, তাহলে পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হয়। তারাও অপমানিত হচ্ছে, আমাদের দেশে প্রতিটি ক্ষণে। অথচ তারাই এ দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাদের মূল্যায়ন করা জরুরি।কারণ তাদের ওপর নির্ভর করে আজও আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল। বস্তুত বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতির মূলে সৃজনশীল গরিব শ্রমিক। শ্রমিকদের জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া যেমন কাম্য নয়,তেমনি সবার শ্রমিক বান্ধব হওয়াও বাঞ্ছনীয়।পরিবহন শ্রমিক,পোশাক শ্রমিক, বিভিন্ন শিল্প কলকারখানার শ্রমিকসহ ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সব কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত সব শ্রমিকের সামগ্রিক স্বার্থ ও সঠিক মর্যাদা রক্ষার্থে মালিক পক্ষকে সব গাফিলতির ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায্য মজুরি প্রদানসহ শ্রমিকসেবা নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করা জরুরি। তবেই হবে মহান ও ঐতিহাসিক মে দিবস-এর অঙ্গীকার পূরণ এবং এ দিবস হবে সার্থক।
আসলে আমরা শ্রম বা শ্রমিকের মর্যাদা বুঝেও বুঝতে চাই না। এটা একটি নেতিবাচক দিক। একজন মানুষের জীবনধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা-এসবই একজন শ্রমিকের প্রাপ্য। এটা নিশ্চিত করতে হবে সরকার ও মালিকপক্ষকেই।পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশে তাই করছে। আর এটাই হচ্ছে শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা। একুশ শতকে এসে শ্রমিকরা এর কতটুকু মর্যাদা বা অধিকার ভোগ করছে? বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ শ্রমিকরা এ দেশের সম্পদ। তাদের কারণেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। এ কারণে তাদের অবহেলার চোখে দেখা ঠিক নয়। এবারের মে দিবস হোক শ্রমিকস্বার্থ নিশ্চিত করার দিন, তাদের পূর্ণ অধিকার আদায়ের দিন। তারা যাতে ভবিষ্যতে কোনো দুর্ঘটনার শিকার না হয়, জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে না ভোগে এবং স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে পারে সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। পরিশেষে বলব,জয় হোক মেহনতি মানুষের, জয় হোক মানবতার।




লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 
raihan567@yahoo.com