আলোকিত জাতি গঠনে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা

397

লেখক, ওয়াহিদুজ্জামান,উপজেলা নির্বাহী অফিসার, নাগরপুর, টাঙ্গাইল : শিক্ষার গুরুত্ব ও সুদূর প্রসারী প্রভাব আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। আমরা জানি শিশুরা জন্ম থেকেই প্রকৃতি ও পারিবারিক অবস্থা থেকেই অনেক কিছু শিখে থাকে যা তাদের বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তুলে। তাই শিশুর বাসস্থান, বিদ্যালয় এবং পরিবেশে যত বেশি শিশুবান্ধব সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করা যাবে ততই তারা বেশি বিকশিত হবে। শিশুর সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা মূলত শিশুর হাতেখড়ি। এই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ এবং প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশের প্রস্তুতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের শিক্ষার অধিকার পূরণ করে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে সক্ষম করে তোলা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “আনন্দহীন শিক্ষা, শিক্ষা নয়”। যে শিক্ষায় আনন্দ নেই সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না’। শিশুদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করার আগে শিশুর অন্তর্নিহিত অপার সম্ভাবনা, অসীম কৌতুহল, আনন্দবোধ ও অফুরান উদ্যম সৃষ্টি করতে একেবারে জীবনের শুরু থেকে সার্বজনীন মানবিক বৃত্তির সুষ্ঠু বিকাশ এবং প্রয়োজনীয় মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতি, শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে আনতে ও ঝড়ে পড়া রোধ হ্রাসকরণে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর সুপারিশমালার ভিত্তিতে ২০১৩ সালে আলাদাভাবে শিক্ষক নিয়োগদানের মাধ্যমে সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। মূলত প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভের পূর্বে ৬ বছরের কম বয়সের শিশুদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা যেখানে ৩ থেকে ৫/৬ বছর বয়সী শিশুদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী তাদের যত্ন, বেড়ে উঠা এবং শিশু অধিকার নিশ্চিত করা, খেলাধুলা, আনন্দ, অক্ষরজ্ঞান এবং গণনার হাতেখড়ির মাধ্যমে তাদের উন্নয়ন করা হয়ে থাকে। এটা প্রাথমিক শিক্ষার ভিতকে আরো শক্ত করেছে নিঃসন্দেহে।

আমাদের দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সেই সাথে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

প্রাক-প্রাথমিকের একটি শিশু জ্ঞান, মানসিক এবং শারীরিক বিকাশের উপর ভিত্তি করে শেখার মাধ্যমে তাদের পরিবেশ এবং কীভাবে অন্যদের সাথে মৌখিকভাবে যোগাযোগ করবেন সে সম্পর্কে শিখে থাকে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য আছে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। পাঠ্যসূচিতে রয়েছে চৌদ্দটি মজার মজার গান, আছে ছাব্বিশটি মজার ছড়া। শিশুদের জন্য নেই পড়ার চাপ, না আছে পরীক্ষা। বরং শ্রেণি কার্যক্রম সহায়িকা হিসেবে আছে আমার বই, এসো লিখতে শিখি, ফ্ল্যাশ কার্ড, ফ্লিপ চার্ট, ব্যঞ্জণচার্ট, স্বরবর্ণ চার্ট। আছে শিক্ষনীয়, আনন্দদায়ক গল্পের বই টিং টংকের গল্প, লাল পোকার গল্প, অপুর বিড়াল, বেড়ানোর একদিন, বর্গরাজা ও ত্রিভুজরানি, চাচা বাজারে যান, ফুল ফোটার আনন্দ, খুশি একদিন কুসুমপুরে, কোথায় আমার মা, মজার মামা ইত্যাদি গল্পের বই। রয়েছে সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষ ও শিশু বান্ধব পরিবেশ, যেখানে আছে খেলার সরঞ্জাম, শিক্ষা সহায়ক সকল ব্যবস্থা, রয়েছে নিয়মিত মনিটরিং কার্যক্রম। প্রতি বছর দেয়া হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য আলাদা বাজেট।

বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু হওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক শিশুও হেসে খেলে তার শিক্ষা গ্রহণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে পারছে। এখানে শিশুদের উপযোগী খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের সামাজিকীকরণ শিক্ষা, নাচ-গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, গল্প বলা, গণনা করা, বর্ণমালা শিক্ষার ক্ষেত্রে দক্ষ ও প্রত্যয়ী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। বস্তুত প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুকে আদর্শ ও সুনাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যেমন-

১. শিশুর স্কুলের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা;
২. শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে আনতে ও ঝড়ে পড়া রোধ হ্রাসকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে;
৩. বিদ্যালয়ের পরিবেশের প্রতি ধারণা লাভ;
৪. বিদ্যালয় ভীতি ও পরীক্ষা ভীতি হ্রাসকরণ;
৫. স্কুল শিক্ষক সম্পর্কে ধারণা অর্জন;
৬. শিশুর শিক্ষা জীবনের ভিত তৈরি করতে;
৭. শিশুর নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে;
৮. শিশুর দৈহিক ও মনোজাগতিক বিকাশ ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা পালন;
৯. শিশুর ভালো আচরণ গঠনে ভূমিকা পালন;
১০. দূর্গম ও অনগ্রসর সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখায় আগ্রহী করে তুলতে ভূমিকা পালন;
১১. সার্বজনীন ও বৈষম্যহীন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে;
১২. বিষয়ভিত্তিক শিক্ষায় ভালো করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে;
১৩. শিশুর বিদ্যালয়ের প্রস্তুতির পাশাপাশি পরিবার ও বিদ্যালয়ের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে;
১৪. মুক্ত চিন্তার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে ইত্যাদি।

প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের অন্তর্ভুক্তি, অবস্থান এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়া রোধে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই শিক্ষা “সকলের জন্য শিক্ষা” আন্দোলনের অংশ হিসেবেও ভূমিকা রাখছে। তাই এই শিক্ষার উন্নয়নে সরকারি নানা উদ্যোগের সাথে অভিভাবকদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি সচেতন হতে হবে। আর এভাবেই শিশু শিক্ষার আলো প্রতিটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে যাবে, সেই সাথে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ পাবে একটি আলোকিত জাতি।